রিপাবলিকান রাজনীতিক ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে প্রচারণা শুরু করেছেন। যদিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশবাসীর সেবা করার আগ্রহ খুব সামান্যই রয়েছে তাঁর। আগে যা–ই হোক, এখন ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার এই উচ্চাভিলাষ অদূর ভবিষ্যতে তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টির জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদটি বাগিয়ে নেওয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে।
২০১৬ সালে ট্রাম্প তাঁর সমালোচকদের প্রধানত একহাত নিতে ও নিজের নানা ব্যবসায়িক উদ্যোগের প্রচার–প্রসার ঘটানোর লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেছিলেন। একপর্যায়ে পুরো রিপাবলিকান পার্টির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন, এমনকি তিনি নিজেও এতে বিস্মিত হন।
রিপাবলিকান পার্টির নেতা ট্রাম্প ২০২০ সালে আবারও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। কারণ, প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি যেসব কর্মকাণ্ড করেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা–সুবিধা ব্যবহার করে সেসবের আইনি সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল। তাই পুনর্নির্বাচন করাটা নিজের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে যখন হেরে গেলেন, পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করে বসলেন তিনি। কোনো প্রমাণ ছাড়াই ট্রাম্প দাবি করলেন, এ নির্বাচনী ফলাফল অবৈধ। আর এখন, ট্রাম্প আবার নির্বাচনী মঞ্চে ফিরেছেন। কেননা, তিনি চান হারানো পদ ও ক্ষমতা ফিরে পেতে; তাঁর ধারণা, যা তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
যাহোক, ২০২৪ সালে আমরা আগের মতো ট্রাম্প–বাইডেন লড়াই দেখব—এ সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাবেন—এটি অসম্ভব প্রমাণ করা যদি না–ও যায়, তবে নিশ্চিতভাবেই কঠিন।
ট্রাম্প ২০১৬ সালে যখন জিওপির (রিপাবলিকান পার্টি) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত হন, তখন ‘ঘোর ট্রাম্পবিরোধী’ রিপাবলিকানরা প্রার্থী বাছাই দৌড় থেকে ছিটকে পড়েন। নির্বাচনে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেতার পরও যে কয়েকজন প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা চালিয়ে যান, তাঁরাও রাজনীতি থেকে হয় অবসরে গেছেন, না হয় ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে কোনো না কোনো সময় পদ হারিয়েছেন। এটি ট্রাম্পকে দলের ওপর পাকাপাকি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাসহ ২০২০–এর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে অংশগ্রহণের সহজ সুযোগ করে দেয়। অবশ্য, ওই সময়ের পর অনেক কিছুই এখন বদলে গেছে।
২০২০ সালের নির্বাচনে হারার পর ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে খারাপ ফল করেছে ট্রাম্পের দল। রিপাবলিকান পার্টির প্রভাবশালী অনেকেই এখন সাবেক এই প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন; যাঁদের মধ্যে রয়েছেন এমন কয়েকজন, যাঁরা ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প হারার পর তাঁর ‘ভোটের ফলাফল চুরির’ গল্পকে সমর্থন করেছিলেন।
এ ছাড়া রিপাবলিকান ভোটারদের অনেকে ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন। এর কারণ, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চলা একের পর এক আইনি ঝামেলা ও প্রতিবন্ধকতা। তাঁদের আশঙ্কা, ট্রাম্প এসব উতরে যেতে পারবেন না। তাই অনেকেই পরবর্তী নির্বাচনের জন্য বিকল্প প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর চিন্তাও করে রাখছেন। বিকল্পের দাবিও জোরদার হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের বিকল্প হিসেবে কয়েকজনের নাম আলোচনায় এসেছে। তাঁদের একজন রন ডিস্যান্টিস। তিনি ফ্লোরিডার গভর্নর হিসেবে সম্প্রতি আবার নির্বাচিত হয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডিস্যান্টিস রিপাবলিকান পার্টিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করেছেন। বিশেষত ট্রাম্পের বিরোধিতা করা, করোনার টিকাবিরোধী অবস্থান, সমকামীদের পক্ষে কথা বলে তিনি আলোচনায় এসেছেন। অন্তত দুটি জনমত জরিপ আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী চূড়ান্তের সম্মুখযুদ্ধে ট্রাম্পের চেয়ে তাঁকে এগিয়ে রেখেছে।
আরও কয়েকটি পরিচিত মুখ ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হতে ট্রাম্পের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারেন। তাঁদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দূত নিকি হ্যালি রয়েছেন। তাঁরা তিনজনই ট্রাম্পের প্রশাসনে কাজ করেছেন। ট্রাম্প তাঁদের নিজ নিজ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আলোচনায় আরও শোনা যাচ্ছে ভার্জিনিয়ার গভর্নর ও রিপাবলিকান উদীয়মান নেতাদের একজন গ্লেন ইয়ংকিনের নাম। দলটির ভোটার ও নেতাদের অনেকের ধারণা, এই নেতাদের কেউ একজন ট্রাম্পকে পাশ কাটিয়ে রিপাবলিকানদের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ নীতি এগিয়ে নিতে সক্ষম হবেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র, দেশটির গণতন্ত্র ও রিপাবলিকান পার্টির জন্য কার্যকর কৌশলগুলোর একটি হলো প্রার্থিতার দৌড় থেকে ট্রাম্পের সরে দাঁড়ানো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে রনকে তাঁর (ট্রাম্পের) সমর্থন জানানো। তবে ট্রাম্পের স্বভাব ও চরিত্রের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন, এটা স্বপ্নাতীত কল্পনা। আরেকটি ঘটনা ঘটতে পারে, একের পর এক আইনি ঝামেলায় জর্জরিত ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে পারলেন না, প্রচারে অংশ নিতে পারলেন না। তবে এরপরও রিপাবলিকান পার্টি ট্রাম্পের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবে, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই।
দৃশ্যপট যেটাই হোক না কেন, রিপাবলিকান পার্টির বিকল্প প্রার্থীকে ট্রাম্পের কাছে নির্বাচনের আগে মাথা নোয়াতে হবে, তাঁকে ট্রাম্প সমর্থকদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে, একই কাতারে দাঁড়াতে হবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী কেভিন ম্যাকার্থিকে এমন সংকটেই পড়তে হয়েছে। ট্রাম্প সমর্থকদের ‘বিদ্রোহে’ স্পিকার পদে তাঁর নিয়োগ ঝুলছিল। ১৫তম বারের ভোটাভুটিতে এসে স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। স্পিকার নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থা শনিবার টানা পঞ্চম দিনে গড়ায়। এর আগে শুক্রবার মধ্যরাত নাগাদ ১৪ দফা ভোটেও স্পিকার নির্বাচিত করতে ব্যর্থ হয় প্রতিনিধি পরিষদ।
কেভিন ম্যাকার্থির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প নিজে কিংবা তাঁর পছন্দের কেউ রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত না হলে, সম্ভাব্য রিপাবলিকান প্রার্থীকে নিজ দলেই যথেষ্ট ভুগতে হবে। কেননা, ট্রাম্পের অতীতের কর্মকাণ্ড বুঝিয়ে দিয়েছে, ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি থাকতে তিনি সবকিছু করতে পারেন, করেনও।
এটা ঠিক যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনের এখনো অনেক সময় বাকি আছে। মাঝের সময়টায় পরিস্থিতি নানা দিকে মোড় নিতে পারে। বদলে যেতে পারে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। চলতি বছরের শেষ নাগাদ ট্রাম্পের জেলে যাওয়ার ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনটা হলে ট্রাম্প সমর্থকদের অনেকেই পিছটান দিতে পারেন। জড়ো হতে পারেন রিপাবলিকান পার্টির বিকল্প কোনো প্রার্থীর ছাতার নিচে।
আর ট্রাম্প যদি শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতার দৌড়ে টিকে যান, আরেকজন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকাতে পুরো রিপাবলিকান পার্টি এক হয়ে তাঁকে সমর্থন দেয়, তাহলে নতুন করে আরেকটি বিপর্যয় দেখা যেতে পারে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে।
রিপাবলিকান পার্টিতে ট্রাম্প যে বিভক্তি তৈরি করে রেখেছেন, তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি জোরালো ও প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে ট্রাম্প মরিয়া হয়ে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে নিজ দলে ও দলের বাইরের ট্রাম্পবিরোধীরা একজোট হয়ে আগামী নির্বাচনের আগে তাঁকে প্রতিহত করতে পারেন। আর তা না হলে জো বাইডেন কিংবা ডেমোক্রেটিক পার্টির অন্য কোনো প্রার্থীর হোয়াইট হাউসে প্রবেশ কঠিন হতে পারে।