রাজনৈতিক সংঘাত, হত্যা, অর্থনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এইসব কারণেই পাকিস্তান মূলত বিশ্ব গণমাধ্যমে স্থান পায়। দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের অধীন থাকার পর বেসামরিক ক্ষমতায় থেকেও পেছন থেকে ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ে সেনাবাহিনী। আর এসবের সম্মিলিত ফল- অর্থনৈতিক সংকট।
গত বছরের ডিসেম্বরে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিলো ৫৮০ কোটি ডলার যা কিনা গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই রিজার্ভ দিয়ে সর্বোচ্চ এক মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে বলে জানা গেছে। এরই সাথে বাড়তি হিসেবে এসছে ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশে আসা। ফলে সব মিলিয়ে পাকিস্তান আইএমএফের সব শর্ত মেনে নেবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে আবার।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান জানায়, বিদেশি ঋণের সুদ ও কিস্তি দিতে গিয়েই দেশটির রিজার্ভ ২০১৪ সালের এপ্রিল-পরবর্তী সময়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস এবং স্থানীয় মুদ্রার দরপতনে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে পাকিস্তান। ২০২১ সালের মার্চ মাসে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির বিনিময় মূল্য ছিল ১৭৭, এখন আন্তব্যাংকপর্যায়ে তা ২২৬ রুপিতে উঠেছে। খোলাবাজারে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য পড়ছে ২৬০ থেকে ২৭০ রুপি। এসঅ্যান্ডপি, মুডিস ও ফিচের মতো শীর্ষ তিন ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা পাকিস্তানের ঋণমান অবনমন করেছে।
এত কিছুর পরও পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার মনে করছেন না, পাকিস্তান দেউলিয়া হয়ে যাবে। এই ভয় তিনি একপ্রকার উড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন, পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কে ভাঙন, বিলম্বে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, আইএমএফের ঋণ গ্রহণে গড়িমসি ও কাঠামোগত সংস্কার আনয়নে অনিচ্ছার কারণে সংকট ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাঁরা মনে করছেন, এখন সময় এসেছে এটা স্বীকার করার, আইএমএফের সঙ্গে দেনদরবার ছাড়া পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ব্যুরো (পিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। দেখা গেছে, আবাসন, পরিষেবা ও যোগাযোগ ছাড়া অন্য সব খাতে মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘরে উঠেছে।
মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি খাদ্যপণ্য ও পরিবহন খাতে। ডিসেম্বর মাসে এই দুটি খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৫৫ দশমিক ৯৩ ও ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
আইএমএফ
পাকিস্তানের রিজার্ভ এখন মাত্র ৫৮০ কোটি ডলার। আগামী তিন মাসে পাকিস্তানকে মোট ৮০০ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে আবার চলতি মাসেই দুটি বিদেশি ব্যাংকের ১০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ফলে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছেন পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা। শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক।
দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বরাবরই আইএমএফের ঋণ নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি আইএমএফের শর্ত মেনে ভর্তুকি কমাতে চাননি। তিনি ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশটির নতুন সরকার আইএমএফের শর্ত মেনে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করে এবং শেষমেশ আইএমএফের ঋণ পায় ১১০ কোটি ডলার।
এখন যখন দেশটি রিজার্ভ–সংকটে জেরবার, তখন সেই ইমরান খানই বলছেন, পাকিস্তানের যে অবস্থা, তাতে আইএমএফের ঋণ নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পাকিস্তানের শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আইএমএফের ঋণ না নিলে পাকিস্তান দেউলিয়া হয়ে যাবে। তাঁর আশঙ্কা, মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে।
সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান যে সংকটের মুখে পড়েছে, তাতে গত ৭ মাসে দেশটির প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ দেশ ছেড়েছেন। জনগণের প্রতি ইমরানের আহ্বান, ‘আসুন, আমরা দেশ না ছাড়ি, সবাই মিলে পরিস্থিতি উত্তরণের চেষ্টা করি।’